কন্টেন্টে যান
/   Blog /   তথ্য ও দিক নির্দেশনা  / আইভিএফ পদ্ধতি কি? খরচ ও সুবিধা অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত

আইভিএফ পদ্ধতি কি? খরচ ও সুবিধা অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত

নতুন জীবনের সন্ধানে: আইভিএফ পদ্ধতি কী, বাংলাদেশে খরচ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত

যখন একটি শিশু জন্মের স্বপ্ন দেখে কোনো দম্পতি, তখন সেই স্বপ্ন পূরণ করতে অনেক সময়ই নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং হতাশায় ভরা সেই যাত্রায় আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে আসে এক নতুন আলোর দিশা – আইভিএফ পদ্ধতি। অনেকেই হয়তো এই চিকিৎসা সম্পর্কে জানেন, আবার অনেকের কাছেই এটি একটি অস্পষ্ট ধারণা। আজকের এই বিস্তারিত আলোচনায় আমরা জানবো আইভিএফ পদ্ধতি বা টেস্ট-টিউব বেবি আসলে কী, বাংলাদেশে এর চিকিৎসা, খরচ এবং এর সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে। এই আর্টিকেলটি সেইসব দম্পতিদের জন্য, যারা একটি নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনছেন।


আইভিএফ পদ্ধতি কি? বাংলাদেশে খরচ, সুবিধা অসুবিধা সহ বিস্তারিত

আইভিএফ পদ্ধতি কি

একটা শিশুর কান্নায় যখন পুরো বাড়ি ভরে ওঠে, সেই আনন্দ আর ভালো লাগার অনুভূতি অতুলনীয়। কিন্তু কিছু দম্পতির জীবনে সেই মুহূর্তটা আসতে কিছুটা সময় লাগে। অনেক চেষ্টা, অনেক ডাক্তার দেখানো, অনেক ধৈর্য্য—তবুও যখন কোনো ফল আসে না, তখন মনের মধ্যে একটা গভীর হতাশা বাসা বাঁধে। এমন পরিস্থিতিতেই আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের সামনে নিয়ে আসে এক দারুণ সমাধান, যার নাম আইভিএফ (IVF)

আইভিএফ শব্দের পূর্ণরূপ হলো In Vitro Fertilization। অনেকে একে ‘টেস্ট-টিউব বেবি’ পদ্ধতিও বলে থাকেন। এই পদ্ধতিটি হলো বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার একটি উন্নত এবং অত্যন্ত কার্যকর উপায়। সহজ কথায়, আইভিএফ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে নারীর ডিম্বাণু এবং পুরুষের শুক্রাণু দেহের বাইরে, অর্থাৎ ল্যাবরেটরিতে একত্রিত করে নিষিক্ত করা হয়।


আইভিএফ পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে?

এই পদ্ধতিটি বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয় এবং প্রতিটি ধাপেই সূক্ষ্ম নজরদারি ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।

ধাপ ১: ডিম্বাশয় উদ্দীপনা (Ovarian Stimulation)

এই ধাপে একজন নারীর স্বাভাবিক মাসিক চক্রের পরিবর্তে ডিম্বাশয়কে বিশেষ হরমোন ইনজেকশন বা ওষুধের মাধ্যমে উদ্দীপিত করা হয়। এর ফলে সাধারণত একটির পরিবর্তে একাধিক ডিম্বাণু পরিপক্ক হয়, যা সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। এই প্রক্রিয়াটি ১০-১৪ দিন ধরে চলতে পারে এবং আলট্রাসাউন্ড ও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়।

ধাপ ২: ডিম্বাণু সংগ্রহ (Egg Retrieval)

যখন ডিম্বাণুগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিপক্ক হয়, তখন একটি ছোট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেগুলো সংগ্রহ করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত হালকা এনেস্থেসিয়া দিয়ে করা হয় এবং যোনির মাধ্যমে একটি পাতলা সুঁচ ব্যবহার করে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুগুলো বের করে আনা হয়। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত ৩০ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।

আইভিএফ পদ্ধতি খরচ, সুবিধা অসুবিধা

ধাপ ৩: শুক্রাণু সংগ্রহ এবং নিষিক্তকরণ (Sperm Retrieval & Fertilization)

ডিম্বাণু সংগ্রহের দিনই পুরুষের কাছ থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করা হয়। এরপর ল্যাবরেটরিতে একটি বিশেষ পাত্রে (petri dish) ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু একত্রিত করা হয়। শুক্রাণুগুলো নিজেদের প্রচেষ্টায় ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার চেষ্টা করে। যদি পুরুষের শুক্রাণুর গুণগত মান ভালো না হয়, তাহলে ICSI (Intracytoplasmic Sperm Injection) নামক একটি উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেখানে একটি একক শুক্রাণুকে সরাসরি ডিম্বাণুর ভেতর প্রবেশ করানো হয়।

ধাপ ৪: ভ্রূণ তৈরি ও পর্যবেক্ষণ (Embryo Development & Observation)

নিষিক্ত হওয়ার পর যে ভ্রূণটি তৈরি হয়, সেটিকে কয়েক দিন ল্যাবরেটরিতে একটি বিশেষ ইনকিউবেটরে রাখা হয়। এই সময়ে ভ্রূণটি বিভাজিত হয়ে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ভ্রূণ বিশেষজ্ঞগণ প্রতিদিন ভ্রূণের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করেন এবং সবচেয়ে সুস্থ ও শক্তিশালী ভ্রূণটি বেছে নেন।

ধাপ ৫: ভ্রূণ প্রতিস্থাপন (Embryo Transfer)

এই ধাপটি আইভিএফ পদ্ধতির চূড়ান্ত পর্যায়। সাধারণত নিষিক্তকরণের ৩-৫ দিন পর একটি পাতলা, নমনীয় টিউব (ক্যাথেটার) ব্যবহার করে বেছে নেওয়া ভ্রূণটি নারীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি ব্যথামুক্ত এবং এনেস্থেসিয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রতিস্থাপনের পর যদি ভ্রূণটি জরায়ুর দেয়ালে সঠিকভাবে বসে যায়, তাহলেই গর্ভধারণ সম্পন্ন হয়।

আরো দেখুন: বাংলাদেশের সকল বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের তালিকা


বাংলাদেশে আইভিএফ চিকিৎসার খরচ কত?

অনেকের মনেই এই প্রশ্নটা প্রথমে আসে। আইভিএফ পদ্ধতিটি বেশ ব্যয়বহুল, তবে বাংলাদেশে এখন বেশ কয়েকটি ভালো ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক এবং হাসপাতাল রয়েছে যেখানে এই চিকিৎসা করানো যায়। সাধারণত, বাংলাদেশে আইভিএফ চিকিৎসার মোট খরচ প্রায় ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে, এই খরচ বিভিন্ন কারণে কম-বেশি হতে পারে।

  • হাসপাতালের মান ও অবস্থান: শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ওপর নির্ভর করে খরচ ভিন্ন হয়। উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে খরচ বেশি হতে পারে।
  • ব্যবহৃত প্রযুক্তি: ICSI, লেজার অ্যাসিস্টেড হ্যাচিং (LAH), বা প্রি-ইমপ্ল্যান্টেশন জেনেটিক টেস্টিং (PGT) এর মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে খরচ কিছুটা বাড়তে পারে।
  • ওষুধের খরচ: ডিম্বাণু তৈরির জন্য যে ইনজেকশন বা ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তার খরচও এর অন্তর্ভুক্ত। এই খরচ একেক রোগীর জন্য একেক রকম হতে পারে।
  • অতিরিক্ত প্রক্রিয়া: কিছু ক্ষেত্রে হিমায়িত ভ্রূণ প্রতিস্থাপন (Frozen Embryo Transfer), অথবা অন্য কোনো সহযোগী চিকিৎসার প্রয়োজন হলে খরচ বেড়ে যায়।

আইভিএফ এর সুবিধা ও অসুবিধা

আইভিএফ এর সুবিধা ও অসুবিধা

যেকোনো কিছুরই কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা থাকে। আইভিএফ এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।

আইভিএফ এর সুবিধা:

  • উচ্চ সাফল্যের হার: বন্ধ্যাত্বের অন্যান্য চিকিৎসার তুলনায় আইভিএফ এর সাফল্যের হার অনেক বেশি, বিশেষ করে যখন অন্যান্য পদ্ধতি ব্যর্থ হয়।
  • নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান: যদি পুরুষের শুক্রাণুজনিত সমস্যা (যেমন সংখ্যায় কম বা গতিশীলতা কম) থাকে বা নারীর ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লক থাকে, তাহলে আইভিএফ একটি কার্যকর সমাধান।
  • জেনেটিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ: আইভিএফ এর মাধ্যমে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের আগেই জেনেটিক রোগ আছে কি না, তা পরীক্ষা করা সম্ভব, যা ভবিষ্যতের অনেক জটিলতা এড়াতে সাহায্য করে।
  • দাতা ডিম্বাণু বা শুক্রাণুর ব্যবহার: বিশেষ প্রয়োজনে দাতা ডিম্বাণু বা শুক্রাণু ব্যবহার করে গর্ভধারণ সম্ভব, যা অন্য পদ্ধতিতে সম্ভব নয়।

আইভিএফ এর অসুবিধা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:

  • শারীরিক ও মানসিক চাপ: পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ এবং এতে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের চাপ তৈরি হয়। বারবার হরমোন ইনজেকশন এবং চিকিৎসা ব্যর্থ হওয়ার ভয় মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে।
  • ব্যয়বহুল: এই চিকিৎসাটি বেশ ব্যয়বহুল, যা অনেকের পক্ষেই বহন করা কঠিন হতে পারে।
  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: ডিম্বাণু তৈরির জন্য ব্যবহৃত ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যেমন পেটে ব্যথা, ফোলাভাব, বমিভাব, মেজাজ পরিবর্তন, এবং বিরল ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়ের অতি-উদ্দীপনা সিন্ড্রোম (OHSS)।
  • সাফল্যের নিশ্চয়তা নেই: দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রতিটি প্রচেষ্টাই সফল হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেক দম্পতিকে একাধিকবার চেষ্টা করতে হয়।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশের সেরা ১০ আইভিএফ ইনফার্টিলিটি সেন্টার সমূহ


আইভিএফ কি হালাল বা জায়েজ?

ইসলামে আইভিএফ পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ ইসলামী পণ্ডিত এবং ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে একমত যে, যদি নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়াটি স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব শুক্রাণু ও ডিম্বাণু দিয়ে করা হয় এবং অন্য কোনো দাতার শুক্রাণু বা ডিম্বাণু ব্যবহার করা না হয়, তাহলে এই পদ্ধতিটি জায়েজ। এটি ইসলামে বিবাহের মূল উদ্দেশ্য (বংশবৃদ্ধি) পূরণে সাহায্য করে। তবে, যদি তৃতীয় কোনো ব্যক্তির শুক্রাণু বা ডিম্বাণু ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেটি সম্পূর্ণরূপে হারাম।


আইভিএফ পদ্ধতি চলাকালীন শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি

আইভিএফ একটি কঠিন যাত্রা। এই সময়কালে সঠিক শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

  • স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: পুষ্টিকর ও সুষম খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম এবং হালকা ব্যায়াম শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
  • মানসিক সাপোর্ট: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ইতিবাচক মানসিকতা সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং বা সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দেওয়া যেতে পারে।
  • ধৈর্য ও বাস্তবতা: এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া এবং প্রথমবারই সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই ধৈর্য রাখা এবং বাস্তববাদী হওয়া জরুরি।

শেষ কথা

আইভিএফ পদ্ধতি বন্ধ্যাত্বে ভুগছেন এমন অনেক দম্পতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। হ্যাঁ, এটি একটি কঠিন পথ, যেখানে শারীরিক এবং মানসিক অনেক কষ্ট থাকতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন একটি সুস্থ শিশুর মুখ দেখা যায়, তখন সেই কষ্টগুলো আর কষ্ট থাকে না। বরং, সেই হাসিটা হয় জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ এই ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যান, তাহলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন। সঠিক তথ্য এবং সঠিক সিদ্ধান্ত আপনাকে আপনার স্বপ্নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

মনে রাখবেন, প্রতিটি জীবনই মূল্যবান এবং প্রতিটি স্বপ্নই সত্যি হওয়ার যোগ্য।